সংগৃহীত
একাত্তরের ১৩ ডিসেম্বর পাক হানাদার মুক্ত হয় মানিকগঞ্জ। একাত্তরের এই দিনে মুক্তি পাগল দামাল ছেলেরা এ জনপদ থেকে পাকিস্তানি হানাদারদের বিতাড়িত করে উড়িয়ে ছিল বিজয়ের লাল সবুজ পতাকা। সেই থেকে জেলার সর্বস্তরের মানুষ প্রতি বছর দিনটিকে মানিকগঞ্জ মুক্ত দিবস হিসেবে উদযাপন করেন।
৫২ বছর আগে এইদিনে জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে পিছু হটে যায় মহকুমা শহরে অবস্থান নেয়া হানাদার বাহিনী। সে সময় পাক বাহিনী ঘাঁটি বসিয়েছিল মানিকগঞ্জের সিঅ্যান্ডবি’র ডাক বাংলোতে। এখান থেকেই জেলার বিভিন্ন এলাকায় রাজাকারদের নিয়ে হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করে পাক বাহিনী।
পাক বাহিনীর মূল ব্যারাক ছিল মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন পিটিআই ভবনে। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ রাতে মানিকগঞ্জের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করার জন্য ওই দিনই মানিকগঞ্জে অ্যাডভোকেট খোন্দকার চাঁন মিয়াকে চেয়ারম্যান করে মো. মোসলেম উদ্দিন খান হাবু মিয়া, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল হালিম চৌধুরী, খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন, সৈয়দ আনোয়ার আলী চৌধুরী, মীর আবুল খায়ের ঘটু ও মফিজুল ইসলাম খান কামালকে নিয়ে সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়।
পাকবাহিনী, আল-বদর, আল-শামস, রাজাকারদের আক্রমণ ও ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে মানিকগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধারা দুটি সেক্টরে কাজ করেন। অক্টোবরের আগ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের সব কাজই অস্থায়ী সরকারের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বে চলে। ১৭ জুলাই ঘিওর থানা আক্রমণ করে পাক সেনাদের আহত করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিজেদের দখলে আনে বীর মুক্তিযোদ্ধারা। ১৮ আগস্ট হরিরামপুর থানায় প্রবেশ করলে মুক্তিবাহিনীর গর্জনে পিছু হটে পাক বাহিনী।
এরপর ১৩ অক্টোবর সিও কার্যালয়ে সংরক্ষিত পাকবাহিনী ক্যাম্প দখলের জন্য মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করলে পাকবাহিনী পরাজিত হয়। এ সময় পাকবাহিনীর পাঁচ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ অবলম্বন করে। তখন পাকবাহিনীর ৭০টি রাইফেল, তিনটি এলএমজি ও সাত বক্স গুলি মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। পাকবাহিনী ক্যাম্প দখলের পর সেখানকার ওয়্যারলেস কার্যালয় পুড়িয়ে দেওয়ার সময় আগুনে পুড়ে মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুর রহমান শহীদ হন ও মুক্তিযোদ্ধা পানু মোল্লা আহত হন। পরবর্তীতে ৫ অক্টোবর সিংগাইর থানার বায়রা নামক স্থানে ধলেশ্বরী নদীর উত্তর পাড় থেকে নৌকায় চলাচলকারী পাকবাহিনীর ওপর ব্রাশফায়ার করলে ১৫ পাকসেনা নিহত হয়।
মানিকগঞ্জে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ বলে খ্যাত সিংগাইরের গোলাইডাঙ্গা যুদ্ধ। এ যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন তোবারক হোসেন লুডু। ১৯৭১ সালের ১৯ অক্টোবর শুক্রবার। সেদিন গোলাইডাঙ্গা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প দখলের জন্য তিন শতাধিক পাকবাহিনী ১০ থেকে ১২টি নৌকায় সেখানে আসে। এ খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে অবস্থান নেয়। সেখানে দ্বিমুখী আক্রমণে একজন কর্নেলসহ ৮১ পাক সেনা মারা যায় । এছাড়াও স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে শহিদ হন ৯ জন। ১৪ অক্টোবর বালিরটেক ও ১৫ অক্টোবর সুতালড়িতে পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ হয়। বালিরটেক যুদ্ধে দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
২২ নভেম্বর পাক হানাদার বাহিনী গভীর রাতে তেরশ্রী, সেনপাড়া, বড়রিয়া এবং বড়বিলা গ্রামের ঘুমন্ত মানুষের ওপর নারকীয় তাণ্ডব চালায়। নির্বিচারে গুলি, বেয়নেট চার্জ ও বাড়ি-ঘরে আগুন দিয়ে তেরশ্রী জমিদার সিদ্ধেশ্বর প্রসাদ রায় চৌধুরী এবং অধ্যক্ষ আতিয়ার রহমানসহ ৪৩ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে।
১০ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার মিরপুর গ্রামে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ইসমাইল উদ্দিন মোল্লার বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে পাকিস্তানী বাহিনী অতর্কিত হামলা চালায়। এতে বীর মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা প্রতিরোধ করলে প্রায় দুই ঘণ্টা যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা মুনসুর আলম গুলিতে আহত হন। এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনী এলাকার কোকারাম মণ্ডলকে নৃশংসভাবে হত্যা করে এবং পুড়িয়ে দেয় গ্রামটির প্রায় অর্ধশত বাড়ি।
এরপর ১২ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীরা অবস্থান নেয় মানিকগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্যাম্পে। হঠাৎ করেই দুই নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর হায়দার ক্যাম্পে এসে উপস্থিত হন। খবর আসে দক্ষিণাঞ্চল থেকে একটি বিশাল পাক হানাদার বাহিনী মানিকগঞ্জ দিয়ে ঢাকার অভিমুখে (বর্তমান ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ধরে) যাত্রা করছে। সে সময় মুক্তিবাহিনী মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন মানোরা নামক এলাকায় পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এর পরই মানিকগঞ্জের বিজয় নিশ্চিত হয় এবং পুরো শহর আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠে।
১৩ ডিসেম্বর বিজয়ী বেশে বীর মুক্তিযোদ্ধারা মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ মাঠে সমবেত হন। সেদিন তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা মাজহারুল হক চাঁন মিয়ার সভাপতিত্বে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ওই সমাবেশ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। সেই থেকেই মানিকগঞ্জ জেলাবাসী (মানিকগঞ্জ মহকুমা) আজকের এই দিনটিকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় নানান বাঙালি ঐতিহ্যের আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে পালন করে আসছেন।
জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘটিত হয়েছিল ছোট বড় ৪২ টি যুদ্ধ। জেলার সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হয়েছিল সিংগাইরের গোলাইডাঙ্গায়। ওই যুদ্ধে ৮৩ জন পাকবাহিনীকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করেছিল বীর মুক্তিযোদ্ধারা। জেলার বিভিন্ন যুদ্ধে শহিদ হয়েছিল ৫৪ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধে ৯ জন হয়েছিল পঙ্গু আর ৪ জন তাদের বীরত্বের জন্য হয়েছিল খেতাবপ্রাপ্ত।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মহীউদ্দীন বলেন, আজ ১৩ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জ পাক হানাদার মুক্ত দিবস। এ দিনে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক দিয়ে পাক হানাদাররা পালিয়ে যায়। সরকার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশ করে মাসিক সম্মানিসহ নানা সুযোগ সুবিধা দিচ্ছেন। স্বাধীনতার ৫২ বছর পাড় হলেও একাত্তরে বিরোধিতা করা শান্তি বাহিনীর তালিকা আজও প্রকাশ হয়নি। এ তালিকা প্রকাশের দ্রুত প্রকাশের দাবি জানান তিনি।